উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

 

উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

আমরা মানব সমাজে বসবাস করি, আর এই সমাজে টিকে থাকতে হলে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পথে কিছু সম্পর্ক এমন হয়, যা আমাদের জন্য বিশেষ অর্থ বহন করে। মানবজাতির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, সবার সঙ্গে নয়, তবে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সঙ্গে আমরা গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলি। এসব সম্পর্ক আমাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একটি সুন্দর জীবন ও মানসিকতার ভিত্তি তৈরি করে।

কিছু কিছু সম্পর্ক আমাদের জীবনে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন অনেক সম্পর্ক আমরা মনের অজান্তেই তৈরি করি, যা পরে দেখা যায়, আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কখনো কখনো সেই সম্পর্কগুলোতে জড়িয়ে আমরা নিজেদের জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিই। তবে সব সম্পর্ক এমন হয় না। অনেক সম্পর্ক আজীবন মনে রাখার মতো হয় এবং আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলে। সব সম্পর্কের শুরু সুন্দর নাও হতে পারে, কিন্তু কিছু সম্পর্কের শুরু হয় মধুর; যদিও শেষটা অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

সূচনা

প্রত্যেকটি সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় বা তার আগে আমরা অনেক কিছুই লক্ষ্য করতে পারি না। নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানোর সময়ও আমরা বুঝতে পারি না যে সেই সম্পর্কটি আমাদের জন্য সঠিক কিনা। এ কারণে অনেক সময় আমাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। তবে সাধারণত প্রত্যেক সম্পর্কের শুরুটা মধুর হয়ে থাকে। নতুন কোনো সম্পর্ক গড়তে গেলে আমাদের মন এবং আবেগ নতুন করে জেগে ওঠে, যা সেই মুহূর্তে আমাদের সম্পর্ককে বিশেষ রঙিন করে তোলে।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাথমিক আবেগ কমে যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা আজীবন থেকে যায়। শুরুটা কেন এত মধুর হয়? কারণ, সম্পর্কের সূচনায় আমাদের মানসিক, শারীরিক এবং মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নতুনভাবে সক্রিয় হয়। আমরা তখন আমাদের সামনে থাকা প্রিয় মানুষটিকে অফুরন্ত ভালোবাসায় ঘিরে রাখি, যা সেই মধুরতার মূল কারণ।

আরো পড়ুনঃকিভাবে জীবন সঙ্গী নির্বাচন করবেন-How to choose a life partner

প্রত্যেক সম্পর্কের শুরু সাধারণত মধুর হয়, কারণ নতুন সম্পর্কে জড়ানোর পর আমরা প্রতিনিয়ত প্রিয় মানুষটিকে কল্পনায় রাখি। তার কথাই আমাদের চিন্তায় ভর করে—সে কী করছে, কোথায় আছে, কোথায় যাচ্ছে—এসব নানা ভাবনা আমাদের মনে ঘুরপাক খায়। এই ধরনের চিন্তা আমাদের মনে এক ধরনের মানসিক শান্তি এনে দেয়। এ কারণেই সম্পর্কের সূচনা সাধারণত এত মধুর মনে হয়।

সম্পর্ক তৈরীর পূর্বে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য করা

সম্পর্ক তৈরির আগে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করা উচিত। তবে এসব বিষয় সম্পর্কের ধরণ ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বিভিন্ন সম্পর্কের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সম্পর্ক গড়ার আগে যেসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার, তার মধ্যে রয়েছে: বিপরীত পক্ষের মানসিক চিন্তাভাবনা, অর্থনৈতিক লোভ-লালসা, যত্নশীলতা, এবং মনের ভাব প্রকাশের ধরন। যদিও অনেক সময় এসব বিষয় সম্পর্ক তৈরির আগে পুরোপুরি বোঝা যায় না, তবে সচেতন চেষ্টা করলে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব।

যদি দেখা যায়, যার সঙ্গে আপনি সম্পর্ক গড়তে যাচ্ছেন তার মানসিক চিন্তাভাবনা সবসময় নেতিবাচক বা খারাপ, তবে এমন ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ানোই ভালো। তেমনই, যদি তার মধ্যে অর্থনৈতিক লোভ-লালসা থাকে বা যদি মনে হয় যে ব্যক্তি আপনার প্রতি যত্নশীল নয় এবং তার মনের ভাব প্রকাশের ধরণ অস্বাভাবিক, তবে এই ধরনের সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।

উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

সম্পর্কের শুরুতে আমরা হয়তো এই বিষয়গুলো পুরোপুরি বুঝতে পারি না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন হয়তো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমান সময়ে অনেক সম্পর্ক কেবল সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে বা আর্থিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য গড়ে ওঠে, যা প্রকৃত ভালোবাসার অভাবের ইঙ্গিত দেয়। তাই, সম্পর্ক গড়ার আগে এসব বিষয় ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখায় দুজনের ইচ্ছা শক্তি থাকা

সম্পর্ক তৈরি করার চেয়ে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অনেক বেশি কঠিন। একটি সম্পর্ক গড়তে যে পরিমাণ ধৈর্য ও পরিশ্রম প্রয়োজন হয়, সেটির চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্য এবং ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। কখনো কখনো আপনি দেখতে পাবেন, আপনার বিপরীত পাশে থাকা মানুষটি আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছে বা ইগনোর করছে, কিন্তু তবুও আপনি তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।

এমন পরিস্থিতিতে যদি সেই মানুষটি আপনার ভালোবাসা এবং চেষ্টা বুঝতে না পারে, তবে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, এখানে সম্পর্ক রক্ষার জন্য কেবল আপনি একাই লড়াই করছেন। এই একতরফা প্রচেষ্টায় সম্পর্ক কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দুই পক্ষেরই সমান ইচ্ছাশক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। যদি তা না থাকে, তবে সম্পর্ক দ্রুত ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আরো পড়ুনঃমানব জীবনে বিদ্যুতের প্রয়োজন-বিদ্যুৎ ব্যবহারের নিয়মাবলী

যদি সম্পর্ক ভেঙে যায়, সেক্ষেত্রে একজন মানুষ বেশি কষ্ট পাবে—সেই ব্যক্তি যিনি সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। অপর প্রান্তের মানুষটি অনেক আগেই সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেছে। একটি সম্পর্ক কখনোই একজনের প্রচেষ্টায় টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং, এটি বলাই যায় যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য উভয়ের সমান আগ্রহ এবং পরিশ্রম অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু তখনই একটি সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী এবং সফল হতে পারে।

সুসম্পর্ক ধরে রাখার প্রবণ ইচ্ছা থাকা

আমরা খুব কম সময়ই মানুষের সঙ্গে গভীর সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। বর্তমানে কারও সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। হয়তো আপনি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান, কিন্তু সমাজের কিছু মানুষ তা চায় না। তাদের নানা উস্কানি ও নেতিবাচক প্রভাব আপনার সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, দুজনেরই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সমাজের কিছু মানুষের কারণে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়।

উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

এরকম পরিস্থিতিতে যদি সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়, তাহলে বলা যায়, হয়তো সেই দুজন প্রকৃতপক্ষেই একে অপরকে মন থেকে চায়নি। কারণ যদি সত্যিই ভালোবাসা গভীর এবং প্রকৃত হয়, তাহলে সামাজিক চাপ বা তৃতীয় পক্ষ কখনো সেই সম্পর্ক ধ্বংস করতে পারত না।

বিচ্ছেদের পরেও প্রিয় মানুষকে প্রিয় রাখা

ইতিহাসের পাতায় আমরা অনেক প্রেমের গল্প পড়েছি, যেখানে সম্পর্কের গভীরতা এবং ভালোবাসার সত্যিকারের উদাহরণ মেলে। কিন্তু আজকের সম্পর্কগুলো যেন অস্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন অনেক সম্পর্ক গড়ে ওঠে কেবল সময় কাটানোর জন্য। এর ফলে একজন মানুষ প্রকৃতভাবে ভালোবাসে, আর অন্যজন শুধুমাত্র ব্যবহার করে। যখন এই ব্যবহারের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন দূরত্ব তৈরি হয়। নানা অজুহাতে সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়, এবং একসময় বিচ্ছেদ ঘটে।

বিচ্ছেদের পরেও একজন মানুষ তার প্রিয় মানুষটিকে ভুলতে পারে না, কারণ সে সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভব করেছিল। অন্যদিকে, যার জন্য সম্পর্কটি শুধুই সময় কাটানোর মাধ্যম ছিল, সে দ্রুতই সেই মানুষটিকে ভুলে যায়। প্রকৃত ভালোবাসা কখনো কাউকে ভুলতে দেয় না। তাই বিচ্ছেদের পরও একজন প্রিয় মানুষকে প্রিয় হিসেবেই রেখে দেয়।

আরো পড়ুনঃত্বকের অ্যালার্জি | কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানেন কি?

উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে তাহলে সূচনা এত মধুর কেন

এমন হাজারো সম্পর্ক প্রতিদিন তৈরি হয় এবং ভেঙে যায়। এই ভাঙা সম্পর্কের গল্পগুলোর মধ্যে একজন থাকে, যে তার প্রিয় মানুষটিকে কখনোই অপ্রিয় করে তুলতে পারে না। এটি আসলে সেই ব্যক্তির মানসিকতার ওপর নির্ভর করে এবং তার প্রকৃত ভালোবাসার প্রতিফলন। বর্তমান সময়ে এমন সম্পর্ক দেখা গেলেও, প্রকৃত ভালোবাসা আজও বিরল এবং অমূল্য।

উপসংহার

গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছিল, "উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে, তাহলে সূচনা এত মধুর কেন?" কথাটি বাস্তবতার একটি কঠিন সত্যকে প্রকাশ করে। আমরা যখন একটি সম্পর্ক তৈরি করি, তখন যে পরিমাণ শ্রম, ভালোবাসা এবং মূল্যায়ন দিয়ে সেটি শুরু করি, যদি সেই একই মনোভাব এবং গুরুত্ব সম্পর্কের পুরো সময় ধরে বজায় রাখা যেত, তবে সম্পর্কগুলো কখনোই বিচ্ছেদে গিয়ে পৌঁছাত না।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সম্পর্ক শুরু করার পর একটি সময়ে আমরা সেই গুরুত্ব ও মূল্যায়ন হারিয়ে ফেলি। প্রিয়জনকে পেয়ে যাওয়ার পর তাকে আর আগের মতো মর্যাদা দিই না। কাজের ব্যস্ততা, জীবনের নানা চাপ, এবং দূরত্বের কারণে সম্পর্কের মধুরতা কমে যায়। ধীরে ধীরে ভুল বোঝাবুঝি, একে অপরকে সময় না দেওয়া এবং তৃতীয় পক্ষের প্রভাব সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯৫% সম্পর্কের শুরু অত্যন্ত মধুর হয়, কিন্তু শেষটা হয় তিক্ত এবং কষ্টদায়ক। এই তিক্ত সমাপ্তির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় ভুল বোঝাবুঝি, অপরের কথায় প্রভাবিত হওয়া এবং একে অপরকে সঠিকভাবে না বোঝা।

তাই, আমাদের উচিত প্রতিটি সম্পর্ককে শুরুর মতোই সারা জীবন ধরে গুরুত্ব এবং ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা। সম্পর্কের প্রতি আন্তরিকতা এবং যত্নই পারে বিচ্ছেদকে ঠেকিয়ে রাখতে। 

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, "উপসংহারে যদি বিচ্ছেদই থাকে, তাহলে সূচনা এত মধুর কেন ছিল?" এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের নিজ নিজ মানসিকতা এবং সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলে আমাদের প্রথম থেকেই সেই গুরুত্ব আজীবন ধরে রাখতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

আমড়া খাওয়ার উপকারিতা

কফির বীজ সংরক্ষণের উপায়

খেজুরের গুড় তৈরির উপায়