হেলাল হাফিজের প্রাথমিক জীবন, শিক্ষা এবং কর্মজীবন
হেলাল হাফিজের প্রাথমিক জীবন, শিক্ষা এবং কর্মজীবন
হেলাল হাফিজ (৭ অক্টোবর, ১৯৪৮ - ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
হেলাল হাফিজ একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি কবি ছিলেন। তাঁকে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি এমন একটি সময়ে সক্রিয় ছিলেন, যখন তাঁর দেশ এবং প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তনের সাক্ষী ছিল। ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
হেলাল হাফিজ নেত্রকোনা জেলার নিজ শহরে স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এটি এমন এক সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয়টি উদীয়মান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এই আন্দোলন পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
তিনি নেত্রকোনা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন “যে জলে আগুন জ্বলে” প্রকাশিত হয়। এটি তাঁকে শক্তিশালী কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় এবং একুশে বইমেলায় সেরা বিক্রিত বইয়ের মর্যাদা পায়। তাঁর কবিতা “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একাধিক প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে।
কবিতা এবং অবদান
“ হয় তো কেটেছে তার মায়া ও মমতাহীন সজল শৈশব
অথবা গিয়েছে দিন
এলোমেলো পরিচর্যাহীন এক রঙিন কৈশোর,
নাকি সে আমার মত খুব ভালোবেসে
পুড়েছে কপাল তার আকালের এই বাংলাদেশে।
বোকা উদ্ভিদ তবে কি
মানুষের কাছে প্রেম চেয়েছিলো?
চেয়েছিলো আরো কিছু বেশি। ”
হেলাল হাফিজ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না থাকলেও তাঁর কবিতা বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে।
“আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফাল্গুনে”।
তাঁর বিখ্যাত শ্লোক:
“এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়”
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেয়াল লিখন, পোস্টার এবং লিফলেটে ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি
পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

তবে, তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের পর তিনি কয়েক বছর স্ব-নির্বাসনের পথ বেছে নেন। তিনি বলেছিলেন, জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ের কারণেই তিনি এই নীরবতা বেছে নেন। পরে তিনি আবার সাহিত্য অঙ্গনে ফিরে আসেন। তাঁর সংকলন “একাত্তুরের কবিতা” এবং তৃতীয় বইয়ের মাধ্যমে তিনি পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
“কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,
“চলো”, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই,
যাবে?”

পেশাগত জীবন
পেশায় একজন সাংবাদিক হেলাল হাফিজ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তবে সংবাদপত্র শিল্পের অস্থিরতার কারণে তাঁকে বারবার চাকরি পরিবর্তন করতে হয়। অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তিনি কিছু সময় জুয়ার প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন, যা তিনি এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছিলেন।
কবিতার বৈশিষ্ট্য
হেলাল হাফিজের কবিতায় জমির প্রতি ভালোবাসা এবং প্রেমের দ্বিধা স্পষ্ট। তবে তিনি নিজেকে একদিকে কোমল প্রেমিক এবং অন্যদিকে বিদ্রোহী দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কবিতায় মানবিক আবেগ এবং জাতীয়তাবাদের গভীর প্রকাশ হয়।
হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। কবি হিসেবে তাঁর সৃষ্টিশীলতা এবং সাহিত্যজগতে অবদান তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।

শেষ জীবন
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হেলাল হাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত সুপার হোমের বাথরুমে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। পরে তাঁকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
হেলাল হাফিজ দীর্ঘদিন ধরে গ্লুকোমা, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস এবং স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছিলেন। আগামীকাল শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) বাদ যোহর জাতীয় প্রেসক্লাবে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিভাবান এই কবি ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়, যা এখন পর্যন্ত ৩৩ বারেরও বেশি মুদ্রিত হয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় দীর্ঘ সময় ধরে সাংবাদিকতা করেছেন।
১৯৮৬ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশের পর হেলাল হাফিজ তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র পঙক্তি:
Comments
Post a Comment